নওমুসলিমা বোন জামিলা (পুষ্প) এর সাক্ষাৎকার পর্ব -২

নওমুসলিমা বোন জামিলা (পুষ্প) এর সাক্ষাৎকার পর্ব -২

আমার মা আমার নামে একটা দোকান করে দিয়েছিলেন। আর এটাই ছিল তার সর্বসাকুল্যে স্থাবর সম্পত্তি। বাবার খানকাহর জন্য জমির প্রয়োজন ছিল। সুলতানপুর গওছাবাদে আমি আমার মাকে বললাম দোকানের কাগজপত্র আমাকে দিন। আমাকে একটা বাড়ি কিনতে হবে। আমি আমার মাকে মিথ্যে বলি। নইলে আমার মা আমাকে কখনোই কাগজ দিতেন না। কাগজপত্র নিয়ে সেই দোকান সেই সময় ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করে ১১ হাজার টাকা বাবাকে খানকাহর জন্য দিয়ে দেই। আর ১ হাজার টাকা আমি নিজে রাখি। সে সময় আমি চাকুরি করতাম ২৫০ টাকা মাসিক বেতন। তিনটি বাচ্চা এবং নিজে ভাড়া বাসা। এক হাজার টাকা জমা করলাম এবং দিল্লী কোর্টপাতিয়ালা হাউসে গিয়ে ইসলাম কবুলের এফিডেভিটের কাজ সম্পন্ন করি। ব্যস, এরপর আল্লাহর নামে খরচ করার নেশা আমাকে পেয়ে বসে। আমি চাইতাম যে, দু’হাতে টাকা কামাই করব এবং আল্লাহর নামে খরচ করব। টাকা উপার্জনের নেশা আমাকে পেয়ে বসে।

নেহরুনগরে আল্লাহ আমাকে সম্পত্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে যেসব শ্রমিক কাজ করত, যারা নামায পড়ত। তারা নামায পড়তে যেত এবং বাইরে গিয়ে নামাযের বাহানায় ছবি দেখতে চলে যেত। আমি যেসব লোক নামাযী তাদের কাজ দিতাম। কিন্তু তারা চালাকি করত। আমি ভাবলাম, আমাকে এমন জায়গায় কারখানা তালাশ করা দরকার যেখানে মসজিদ কারখানার পাশে হবে। অতএব আমি গফরনগরে হাজী কলোনীতে জমি খরিদ করি এবং কারখানা এদিকে শিষ্ট করি। কিন্তু এদিকে আমি যেহেতু একাকী কাজ করতাম এবং মুসলিম এরিয়ায় মসজিদের দরুন শিফট হয়েছিলাম যাতে শ্রমিক-কর্মচারীরা অবশ্যই নামায পড়ে এবং বেশিক্ষণ বাইরে না থাকে। আর কাজেরও যেন ক্ষতি না হয়।
কিন্তু এদিককার মুসলমানরা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছিল যে, কেমন মুসলমান হয়েছে যে ছেলেদের দিয়ে কাজ করাই। এ জাতীয় আরও অনেক কথায় আমি পেরেশান হয়ে পড়ি।

এর জের পড়ে কারখানার ওপর। আমার কারখানার লাল বাতি জ্বলার উপক্রম। আমি আমার ছেলেদের কাছে নেহেরুনগরে চলে যাই। কাজ বন্ধ করে দিই। কারণ ইসলামে শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো জায়েয নেই। আর আমি দরিদ্রদশায় পতিত হই ও অনাহার-অর্ধাহারের সম্মুখীন হই। আমি টুকরা কাগজ বিক্রি করতে শুরু করি। ফলে কিছুটা আশ্রয় জোটে। এদিকে কিছু ভাল মুসলমান বোনের সঙ্গে দেখা হয়। একজন আমাকে বলেন যে, আপনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আপনি আপনার কারবার শুরু করুন। এতো মনগড়া কথা। বোনটির স্বামী মণ্ডলভী যুলফিকার আমাকে এ ব্যাপারে পথ দেখান। তিনি আমাকে আপন মায়ের মতই আমার প্রতি লক্ষ্য রাখেন। আমি হাজী কলোনীতে পুনরায় কারখানা শুরু করি এবং নাইটি, টপ ও পাতিয়ালা সালোয়ার ডিজাইন করে মার্কেটে বিক্রি শুরু করি। এখানেও আমি বিল্ডিং নির্মাণ করি এবং নিজেও এ দিকেই চলে আসি। এরপরই আমি জানতে পাই যে আমি যে ইসলামের ওপর চলছি, কবর পূজা ইত্যাদি ঠিক নয়। এখানে এসেই সহীহ-শুদ্ধভাবে কালেমা পড়ি। এখানে এসেই নামায শিখি। কুরআন করীম পড়ি। তবলীগ জামা’আতে যাই। মুসলিম বোনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমি যখন নামায শিখি এবং তা আদায় করি তখন বুঝলাম যে হাদীসে যে বলা হয়েছে, “নামায মু’মিনের জন্য মে’রাজ”। আসলেই তা মে’রাজ।

(এ কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্না ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন। আমরা তার এই অবস্থাদৃষ্টে ঈর্ষান্বিত হহী। আমরা বলি যে, আপনি তো আল্লাহ্র ওলি এবং অনেক উঁচু দরজার মানুষ।)

বোন জামিলা বলেন যে, আমি ওসব কিছু নই। এরপর অত্যন্ত ঝটপট বলেন, কোনভাবে যদি সেই নামাযের অবস্থা ফিরে আসে। তিনি আমাকে বলতে থাকলেন, এমন কোনো আমল বলুন যাতে করে আমার নামাযের মধ্যে প্রথম দিককার অবস্থা ফিরে আসে।

আমরা বললাম, আল্লাহ্ অসীম দাতা ও দয়ালু। তাঁর দরবারে বিনীতভাবে কাতরকণ্ঠে যা-ই কিছু চাইবেন, পাবেন। বোন জামিলা তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, আমার সাথেও তো এ ব্যাপার ঘটেছে। যখনই আমি চেয়েছি সবকিছু পেয়েছি। বান্দাহ বড়ই অকৃতজ্ঞ, অবিশ্বস্ত। সে চাইতেই জানে না, চায় না।

পবিত্র রমযান মাস। আমি বরাবর রোযা রাখি। নামাযও আদায় কার। কিন্তু দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পারতাম না। ডায়বেটিসের দরুণ আমার ৭।এই অকর্ম হয়ে পড়ে। আমি যেখানে থাকি সেখানে আমার এমন অংশ আছে যেখানে আমি খুব সহজে ভাড়াটিয়াও রাখি। লায়লাতুল কদর এসে গেল। সবাই দাঁড়িয়ে নফল পড়ছিলেন। সে রাতে আমিও জেগে ছিলাম। পায়ের ব্যাথার কারণে আমি উঠতে পারছিলাম না। কোন মুসলমান বোনও আমাকে এ হাতের মাহাত্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলেনি। আমার অন্তর ফেটে যাচ্ছিল যে, কেউ এসে আমাকে সান্ত্বনা দিক। এ রাতের মর্যাদা ও মাহাত্য সম্পর্কে বলুক। এমতাবস্থায় আমি কীভাবে ইবাদত করব। আমাকে সাহায্য করুক।

এরপর আমার অসহায় অবস্থা ফুটে উঠল। আমি বসে বসে সিজদায় পড়ে গেলাম। এবং এভাবে আমার মালিকের সামনে অস্ফুট আর্তনাদ সহকারে কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার তখন হুঁশ ছিল না। ছিলাম আমি আর আমার আল্লাহ্। অসহায় অবস্থা এমন যে ইবাদত-নামাযও নাঁড়িয়ে পড়তে পারব না। এর অনুভূতি ফিরে আসতেই হঠাৎ করেই আমার মনে হল আমি দাঁড়াতে পারি। আর মনে হতেই আমি সোজা দাঁড়িয়ে গেলাম এবং সে রাতে দাঁড়িয়ে খুব নামায আদায় করি ও চলাফেরায় সক্ষম হই। আমি চলাফেরা করতে শুরু করি এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এমন থাকল যে, আমার যেন কোন অসুখ-বিসুখই ছিল না। ডায়বেটিসে চিনির মাত্রাও শেষ হয়ে যায়। এরপর বললেন, ব্যাস, বোন। আমরা খুবই অকর্মণ্য। কোন কাজের নই। আমরা দুনিয়াদারির মধ্যে ফেঁসে গেছি। এরপর সেই একই রোগ।

আমি ফাযাইলে আ’মাল পড়তে শুরু করি। আমি যখন পড়লাম যে, যার ছেলে কুরআনের হাফেজ হবে পরকালে সেই ছেলের মাকে জান্নাতে নূরের টুপি পরানো হবে। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম যে, আল্লাহ। এখন আমি কী করব? আমার দুই ছেলে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েও হয়ে গেছে। কেননা সে সময় তো বাস “সাল্লী আলী কা ইয়া মুহাম্মদ, আল-মদদ কর মদন” এবং কবরস্থানে যাওয়াটাকেই ইসলাম মনে করতাম। ব্যাস, কেবল নিজেই মুসলমান হয়েছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *