নওমুসলিমা বোন জামিলা (পুষ্প) এর সাক্ষাৎকার পর্ব-১
নওমুসলিমা বোন জামিলা (পুষ্প) এর সাক্ষাৎকার পর্ব-১
আমার পূর্বের নাম ছিল পুষ্প।
আমার পিতার নাম শিবরাম ভগত, মায়ের নাম সুমী বাঈ। আমার সম্পর্ক পাঞ্জাবের রাজপুরা জেলার পাতিয়ালার ভগত খান্দানের সঙ্গে। আমরা তিন বোন।
আমার আল্লাহ্ আমাকে ভালবাসতেন। আমার প্রভু, প্রতিপালক আমার প্রতি দয়া করেছেন। আমাকে ঈমানের মতো মহামূল্যবান সম্পদ দান করেছেন। কুফর ও আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলেন। বাহ্যিকভাবে “মুসলিম মহিলাদের শরীর আবৃত করা বা পর্দা করা” এটাই আমার ইসলাম গ্রহণের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়।
আমাদের পরিবারটি ছিল খুবই দরিদ্র। আমার খালার বিয়ে হয়েছিল এক ধনী পরিবারে। আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল ২০ বছর। আমার খালা চেয়েছিলেন যে আমার বোন-ঝিও যেন ধনী পরিবারে এসে যায়। সেজন্য তিনি আপন দেবরের ছেলের সঙ্গে, আমার বিয়ে ঠিক করেন। যিনি ছিলেন সি.বি.আই অফিসার। আমার মা ধনী-গরিবের ভয়ে ভীত হবার কারণে এ বিয়েতে খুব একটা রাজী ছিলেন না। এক ধরনের জোর-জবরদস্তি করেই এ বিয়ে হয়। বিয়ের পর জানতে পারি যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে সে অত্যন্ত বেপরোয়া স্বভাবের ও মদ্যপ। শ্বশুরবাড়িতে আমার অবস্থা ছিল চাকর-বাকরের চেয়েও খারাপ। কাঠের পুতুলের মত আমাকে শ্বশুরবাড়িতে ঘুরানো হত। ১৯৮০ সালে আমার বিয়ে হয় এবং ১৯৮৩ সালে আমার প্রথম পুত্র জন্মগ্রহণ করে। সেসময় আমি অত্যন্ত করুণ দশায় হাসপাতালে ছিলাম। আমার মা-ও আমার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বেচারী আর কী-ইবা করতে পারতেন। অবস্থা এমনটাই ছিল যে আমি লোকের থালা-বাসন ধুয়েছি। ঘর-দোর ঝাড়ু পর্যন্ত দিয়েছি। ইতোমধ্যে আল্লাহ আমাকে দুই ছেলে ও এক মেয়ের মা হবার তৌফিক দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে তীক্ষ্ণ মেধা দান করেছিলেন। ১৯৮০ সালে ২৫০ টাকা মাসিক বেতনে আমি এক সেলাই কারখানায় কাজ শুরু করি। সেখান থেকেই আমার ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কারখানাটি ছিল জনৈক হিন্দুর কিন্তু এর কর্মচারী ও শ্রমিক ছিল মুসলমান এবং বেরেলভী মুসলমান। আমি শাড়ি পরে কারখানায় যেতাম। হাতাবিহীন ব্লাউজ এই পরতাম। একদিন এক শ্রমিক আমাকে বলল, “বোনজী আপনি আমাদের ঈমান খারাপ করছেন।” আমি বললাম, “ঈমান কী?” সে বলল, ‘আমরা মুসলমান। আমাদের এখানে মুসলিম মহিলারা পর্দা-পুশিদা মেনে ও শরীর ঢেকে চলে। এজন্য পুরুষদের ঈমানও নিরাপদ থাকে, মহিলাদের ঈমানও নিরাপদ থাকে।”
আমি বললাম, “ঈমান কী?”
সে বলল, এক কলেমার নাম যা পড়ান হয়। আমি বললাম, “ওরা তো – মুসলিম মহিলা। তারা তাদের ধর্মের কারণে এরূপ চলে।”
মুসলমান শ্রমিকটি খুব দরদভরা কণ্ঠে বলল, বোনজি। আপনি যেই হন ও যাই হন, আমার দিল চায় যে আপনিও আমাদের মা-বোনদের মত কাপড় পরুন।
আমার মনে তার ঈমান ও পর্দা-পুশিদার কথা ধরল। আমি ভাবতে থাকি যে, কেমন সুন্দর ঈমান তার আর তাদের ওখানে মেয়েদের কতটা সম্মান করা হয়। আমার দিল অস্থির হয়ে উঠল। ঐ শ্রমিকটির ঈমানের ভেতর আসার জন্য। পরদিন আমি সেই শ্রমিকটিকে বললাম, “ভাই। আমি তোমার ঈমানের ভেতর আসতে চাই। আমাকে কী করতে হবে?” সে বলল, একটি কালেমা আছে যা পড়তে হবে। আমি বললাম, আমাতে তাড়াতাড়ি পড়াও। বলল, “আমি তো পড়াতে পারি না। আমাদের বাবা পড়াবেন। তিনি অমুক দিন আসেন।”
এখন আমাকে সেই অমুক দিনের অপেক্ষা করতে হল অধীরভাবে। আল্লাহ আল্লাহ্ করতে করতে সেই দিন এসে গেল। এক লম্বা চোগা এবং গলায় বিভিন্ন ধরনের রকমারী মালা ও টুপি পরিহিত বাবা কারখানায় এলেন। তিনি কমল ধরিয়ে আমাকে বলতে বললেন, ‘সাল্লী আলী কা ইয়া মুহাম্মদ, ইয়া আল্লাহ। ইয়া মুহাম্মদ। ইয়া আলী। আল মদদ কর মদদ। (বোন জামীলা যখন এই কালেমা শোনালে আমার তখন হাসি পাচ্ছিল এবং আশ্চর্যও হচ্ছিলাম।। মাঝখানে আমরা বললাম, এটা কালেমা নয়।)
তিনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটা ছিল আমার সেই যমানার ঈমান, ভাই যেমনটি বলেছেন। তিনি যা বললেন, আমিও তা বললাম এবং বহুদিন পর্যন্ত এটাই আমি আওড়াতাম। এরপর আমাকে কবরস্থানে যেতে বলা হল। আমি সেই বাবার মুরীদ হলাম। অতঃপর আমি হিন্দুস্থানের বড় বড় মাযারগুলোতে হাজিরা দিয়েছি এবং সেখানে যা কিছু হয় আমি তা দেখতাম ও করতাম।”
“এদিকে আমি শাড়ির পরিবর্তে স্যুট পরা শুরু করি এবং নিজেই কাপড় ডিজাইন করতে শুরু করি। আমার ডিজাইনকৃত ড্রেস ছিল খুব দামী। আমি পৃথকভাবে মেশিন কিনি এবং নিজেই ডিজাইন করে ড্রেস তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। আমার কারবার বেশ জমে উঠল। ১৯৮২ সালে উখলা, ফিস-এ আমি আমার কারখানার ভিত্তি স্থাপন করি এবং পৃথকভাবে মুসলমান শ্রমিক ও কর্মচারী নিয়োগ দেই। আমার অর্থ উপার্জন হয়ে উঠল একমাত্র নেশা। আর আল্লাহই আমাকে এই পরিমাণ যোগ্যতা দিয়েছিলেন যে, আমি নেহেরুনাগার তিনতলা একটি গোটা ক্যাম্পাস ক্রয় করে ফেলি। হ্যাঁ, আরও একটি কথা মনে পড়ল, আমি যখন কারখানায় কাজ করতাম তখন বাবার খানকাহর দরবার ছিল।